এ্যাটেনশান ডেফিসিট হাইপারএ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (Attention deficit hyperactivity disorder) বা ADHD অর্থ হিসাবে বলা যেতে পারে “অতি অমনোযোগী এবং অতিচঞ্চলতাজনিত বিশৃঙ্খলা।” একে Hyperkinetic disorder ও বলা হয়।
অতীতে এটিকে Minimal brain dysfunction বলা হতো কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সাথেসাথে এই পরিভাষাগুলোও আধুনিকায়ন হয়েছে। এটি একটি স্নায়ু সংক্রান্ত গোলযোগ।
এ সমস্যা আক্রান্ত শিশুরা প্রকৃতপক্ষে অন্যের মনোযোগ আকর্ষন করার উদ্দেশ্যে এমন ধরণের কার্যকলাপ বা চঞ্চলতা প্রকাশ করে যা পারিপার্শিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হয় না এবং অনেকসময় অন্যের বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে।
এসকল শিশু কারো সাথে ঝগড়া বা মারামারিতে অপেক্ষাকৃত কম লিপ্ত হয়, কিন্তু তার কাছে মনে হয় যে, তাকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না, অথবা তারদিকে কারো মনোযোগ নেই, “কেন আমার বিষয় নিয়ে এরা কথা বলছে না”, “এদের কাছে আমি কেন গুরুত্বপূর্ন নই”, ইত্যাদি। ফলে সে অন্যের মনোযোগ আকর্ষনের জন্য অতিচঞ্চলতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ করতে থাকে, হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, কোনকিছু ভেঙ্গে ফেলে, অযথাই লাফাতে থাকে।
আর এইসব কার্যকলাপ করার কারণে সে তার দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজগুলোর প্রতি মনোনিবোশ করতে পারে না, বরং অমনোযোগী হয়ে ওঠে।
শৈশবকালীন মানসিক বিশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা গুলোর মধ্যে ADHD সর্বাধিক দৃষ্ট সমস্যা এবং গড়ে ৫% শিশু এ সমস্যা নিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত করে।
কারা অধিক আক্রান্ত হন (More Prone To)
৪ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরা অধিক আক্রান্ত হন তবে ১৭ বছর বয়সের পরেও হতে পারে, অর্থাৎ শৈশব অবস্থায় শুরু হলেও এর ধারাবাহিকতা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও অব্যহত থাকে।
ছেলে শিশুরা অধিক আক্রান্ত হয়।
কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে, স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত এ সমস্যা নির্নয় করা যায় না।
পরিবারে একজন শিশুর ADHD থাকলে পরিবারের অন্য শিশুদেরও ADHD হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
কারন (Causation)
১। জিনগত কারণ (Genetic factor) যথা,
- পরিবারে মানসিক রোগের ইতিহাস।
- Monozygotic জমজ শিশুদের মধ্যে ADHD অধিক হতে দেখা যায়, যেখানে Dizygotic জমজ শিশুদের মধ্যে ADHD অপেক্ষাকৃত কম দেখা দেয়।
২। হরমোন সংক্রান্ত কারন, যথা
ডোপামিন (Dopamine) এবং নরএফিনেফ্রিন (Norepinephrine) ADHD -এর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
৩। জন্মগত ত্রুটিজনিত কারণ, যথা
- মায়ের নিজস্ব অনিচ্ছা অথবা পারিবারিক অনিচ্ছায় গর্ভধারণ বা অনৈচ্ছিক গর্ভধারণ।
- শিশুর মস্তিস্কের বিকাশগত ত্রুটি।
- আক্রান্ত শিশু, মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মায়ের কোনধরণের মারাত্মক জীবানুজনিত সংক্রামন অথবা বিষাক্ততা।
- সময়ের পূর্বেই ভূমিষ্ট হওয়া।
- দীর্ঘমেয়াদী প্রসব।
- প্রসবকালে শিশুর মস্তিস্কে আঘাত বা শ্বাসকষ্ট বা দীর্ঘক্ষন কান্না না করা।
- ফরসেপ ডেলিভারী।
- প্রসবকালীন শিশুর Apgar scores কম থাকা।
- প্রসবপরবর্তী শিশুর মারাত্মক জীবানুজনিত সংক্রামন।
- গর্ভাবস্থায় বিশেষ কিছু অপ্রয়োজনীয় ভিটামিনসমৃদ্ধ এ্যালোপ্যাথি ঔষধ সেবন।
৪। পরিবেশগত কারন, যথা
- শিশুর আচরণের উপর বাবা-মায়ের যথেষ্ট মনোযোগ এবং নিয়ন্ত্রন না থাকা।
- শিশুর উপর দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ।
- দাম্পত্যকলহ বা শিশুর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ।
- পারিবারিক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা।
ক্লিনিক্যাল ফিচার (Clinical features)
লক্ষন (Symptoms)
(শিশুদের ক্ষেত্রে)
- কোনকিছুতে স্থিরভাবে মনোনিবেশ করে থাকতে পারে না।
- পড়তে অথবা খেলতে গেলে সমস্ত মনোযোগ সহকারে পড়তে বা খেলতে পারে না।
- পড়ার ফাঁকে ফাঁকেই অন্যদিকে বারবার মনোনিবেশ করতে থাকে। অনবরত হাত-পা নাড়াতে থাকে, অকারনেই রুল-পেন্সিল নিয়ে খেলতে থাকে, রুল-পেন্সিল মুখে দেয়, কামড়ায়।
- অত্যাধিক চঞ্চলতা প্রকাশ করে।
- কোনকিছু বললে তা মনোযোগ সহকারে শোনে না।
- কোন নির্দেশনা দিলে তা পালন করে না।
- কোনকিছু করতে বললে তা নিজের ইচ্ছা মতো করে এবং ভূলভাবে করে।
- সহজেই উত্তেজিত হয়ে যায়, চিৎকার করে, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে।
- অকারণে অদ্ভূৎ আচরণ করে, গান গায়, গানের সূরকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে, মুখ ভ্যাংচায়, উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ করে।
- দৈনিক কাজকর্ম ঠিকমতো করে না, স্কুলের পড়া তৈরী করে না।
- বেপরোয়া আচরণ করে এবং খুবই অধৈর্য্য প্রকৃতির হয়।
- স্কুলে সমবয়সীদের প্রতি কর্তৃত্বসূলভ আচরণ করে, অনেকসময় সহপাঠীদের প্রতি আক্রমনাত্বক মনোভাব প্রকাশ করে।
- বিপদ বা ঝুঁকি সম্পর্কে সম্পূর্ন উদাসীন থাকে। নিষেধ করা স্বত্বেও ঝুঁকিপূর্ন এবং বিপদজনক স্থানে চলে যায়।
- অত্যাধিক বাচলতা প্রকাশ করে, বড়দের মুখে মুখে তর্ক করে।
- প্রায়শঃই অন্যের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে অথবা খবরদারি করে।
- কোন প্রশ্ন সম্পূর্ন শেষ করার পূর্বেই উত্তর দিতে শুরু করে।
- যথেষ্ট খেলনা থাকা স্বত্তেও প্রায়শঃই বাবামায়ের কাছে, যা দেখে তাই কিনতে চাই এবং খুব শীঘ্রই সে খেলনা ভেঙ্গে ফেলে।
- প্রায়শঃই টাকা-পয়সা চুরি করে এবং দোকানে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো জিনিস কিনে কিন্তু টাকার অঙ্ক সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে, টাকা ফেরত আনতে পারে না।
- স্কুলে গেলে, প্রায়শঃই বন্ধু-বান্ধব এবং সহপাঠিদের বিভিন্ন খেলাধুলোর জিনিস বা ছোটছোট বস্তু চুরি করে।
- কোন কাজ গুছিয়ে করতে পারে না, নিজের পোশাক আশাক, বই-খাতা কিছুই গুছিয়ে রাখে না, স্কুলে গেলে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হারিয়ে আসে।
- ঘুম কম হবে অথবা অস্থির নিদ্রা হবে।
(প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে)
- শৈশবের ADHD এর ইতিহাস এবং ধারাবাহিকতা থাকবে।
- কোন কাজে স্থিরভাবে মনোনিবেশ করতে পারবে না।
- একটি কাজ অসম্পূর্ন রেখেই অন্যকাজ শুরু করে দেবে।
- একদন্ডও স্থির থাকতে পারবে না। সবসময় ব্যস্ত থাকবে তবে সেগুলোর সবই অসফল ব্যস্ততা।
- অন্যের প্রতি কতৃত্ব আরোপ করবে।
- অল্পেই ঝগড়ায় লিপ্ত হবে এবং আক্রমনাত্বক মনোভাব প্রকাশ করা।
- ভীষন অস্থির এবং অধৈর্য্য প্রকৃতির হবে।
চিন্থ (Signs)
অস্থির।
চঞ্চল।
অধৈর্য্য।
ঝগড়াটে।
জটিলতা (Complications)
(শিশুদের ক্ষেত্রে)
- দূর্ঘটনা।
- স্কুলে ফলাফল খারাপ করা।
- সহপাঠীদের সাথে সর্ম্পক নষ্ট হওয়া এবং একাকিত্বে ভোগা।
- চুরি করার অভ্যাস তৈরী হওয়া।
(প্রাপ্তবয়স্তদের ক্ষেত্রে)
- বারবার সম্পর্ক নষ্ট হওয়া।
- বিষন্নতায় ভোগা।
- মাদকাসক্তি।
- বারবার চাকুরী হারানো।
- অনিদ্রা বা অস্থির নিদ্রা।
ব্যাবস্থাপনা (Management)
- অবশ্যই লক্ষনসাদৃশ্যে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে এবং রোগীর অভিভাবককে কিছুদিন ধৈর্য্য সহকারে ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিতে হবে।
- শিশুর প্রতি সহনশীল মানসিকতা প্রকাশ করতে হবে এবং সম্পূর্ন স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। শিশুর প্রতি অধিক গুরুত্ব দিলেও সেটা শিশুকে বুঝতে দেয়া যাবে না।
- শিশুকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখতে হবে, কিন্তু সেটা শিশুকে বুঝতে দেয়া যাবে না।
- শিশু কোন অশ্লীল বা অশোভন কথা বললে, আচরণ করলে, অঙ্গভঙ্গি করলে আশেপাশের সকলকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। হাসলে বা বকা দিলে শিশু আরো উৎসাহিত হবে এবং বারবার ঐ কাজ করতে থাকবে।
- শিশুর নেতিবাচক দিকগুলো স্বাভাবিকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে এবং তার আচরণের উপর নিয়ন্ত্রন রাখা শেখাতে হবে।
- নিরাপদ পরিবেশ এবং আবাসস্থল দিতে হবে। যা তার এবং তার আশেপাশের মানুষের জন্য বিপদজনক, যেমন ছুরি, ব্লেড, ধারালো বস্তু ইত্যাদি সরিয়ে রাখতে হবে।
- দৈনিক ছোটছোট কিছু কাজ দিতে হবে যা সে একটানা করতে পারবে এবং উন্নতির সাথেসাথে কাজগুলো ক্রমে বাড়াতে হবে।
- সমবয়সী অন্য ADHD আক্রান্ত শিশুদের সাথে দলগত কাজ দিতে হবে।
- শিশুর জন্য একটি সাধারণ এবং বাস্তবসম্মত রুটিন তৈরী করতে হবে, যা অভিভাবকের পক্ষে তত্ত¡াবধান করাও সহজ এবং সুবিধাজনক হবে আর শিশুর জন্যও কঠিন হবে না।
- শিশুকে উত্তেজনাপূর্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ন পরিহার করে বরং অন্ততঃ সপ্তাহে একদিন হলেও শান্ত ও অনাড়ম্বড় স্থানে নিতে যেতে হবে, যেখানে গোলমালের সুযোগ নেই বা খুবই কম।
- “ভালো কাজের জন্য পুরস্কার” নিয়ম চালু করতে হবে, কিন্তু মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার করা যাবে না।
- সাইকোথেরাপী (Psychotherapy) দিতে হবে।
প্যাথলজীক্যাল ইনভেষ্টিগেশান (Pathological investigations)
রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস সংগ্রহ করতে হবে,
⮲. বংশগত ইতিহাস।
⮲. পারিবারিক ইতিহাস।
⮲. জন্মগত ইতিহাস।
⮲. জন্মপরবর্তী বয়সানুপাতিক ধাপসমূহের ইতিহাস।
⮲. ব্যক্তিগত ইতিহাস।
শারিরীক অবস্থা পরীক্ষা করতে হবে।
মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করতে হবে।
স্নায়ুসংক্রান্ত অবস্থা পরীক্ষা করতে হবে।
DSM diagnostic criteria. পর্যবেক্ষন করতে হবে।
DSM diagnostic criteriaDSM-5
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এ্যাসোসিয়েশন (APA) কতৃক লিখিত একটি ম্যানুয়্যাল বই, যা Diagnostic and statistical manual of mental disorders নামে পরিচিত। বিশ্বের প্রায় ১৬০ জন (এ পর্যন্ত) শ্রেষ্ঠ সাইকিয়াট্রিষ্ট এই বইটির পেছনে দিনরাত কাজ করেন, বিশ্বের বিভিন্নধরনের মানসিক রোগের বর্ননা দেন। বইটিতে কোন চিকিৎসা বিষয়ক তথ্য থাকে না। তবে মানসিক রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জনের জন্য এই বইটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বইগুলোর মধ্যে একটি, বলা হয়।
যে কোন সমস্যায় আপনার নিকটস্থ দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।
আপনার সুস্বাস্থ্য ও সার্বিক মঙ্গল কামনায়,
বি.এইচ.এম.এস.
নওয়াব আলী হোমিও চিকিৎসালয়, বালুবাগান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
প্রাক্তন প্রভাষক, রহনপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।