“বদঅভ্যাস (Bad habit)” সম্পর্কে জানার পূর্বে আমাদের “অভ্যাস (Habit)” কি সে বিষয়ে জানা প্রয়োজন। “অভ্যাস” এমন একটি শারিরীক (Physical) অথবা মানসিক (Psychological), ঐচ্ছিক (Voluntary) বা অনৈচ্ছিক (Involuntary) কর্মকান্ড যা আমরা ধারাবাহিকভাবে করতে থাকি বা করতে বাধ্য হই।
হতে পারে এটি মানসিক বা শারিরীক আনন্দ প্রাপ্তির আশায় অথবা লৌকিক বা পরলৌকিক মুক্তি পাবার আশায় অথবা হতে পারে এটি খাদ্য, অর্থ, প্রসংশা, সামাজিক-পারিবারিক-পারিপাশির্^ক সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার আশায় বা আত্মতৃপ্তির আশায়।
প্রকারভেদ (Classification)
অভ্যাসকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি,
- ঐচ্ছিক (Voluntary) বা ইচ্ছাধীনঃ যা আমরা স্বেচ্ছায় এবং সজ্ঞানে করে থাকি। যেমন হাঁটা, চলা, বলা, একটা নিদৃষ্ট সময়ে নিদৃষ্ট কাজ করা ইত্যিাদি।
- অনৈচ্ছিক (Involuntary) বা অনিচ্ছাধীনঃ যা আমরা অনৈচ্ছিকভাবে এবং নিজেদের অজান্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে থাকি। যেমন, কোথাও যাবার পূর্বে বাইরের পোশাক পড়া, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু চুল গুছিয়ে নেয়া, একটু প্রসাধনী ও সুগন্ধি ব্যবহার করা ইত্যাদি।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, মনঃস্বাস্তিক প্রেক্ষাপটে ঐচ্ছিক এবং অনৈচ্ছিক অভ্যাস, ব্যক্তির ইচ্ছা এবং অনিচ্ছার উপর উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল এবং একটি অপরটির সাথে পরিবর্তনযোগ্য। যেমন, অনৈচ্ছিক অভ্যাসের ক্ষেত্রে ব্যাক্তি মনে করতেই পারেন যে, তিনি বাইরে যাবার সময় প্রসাধনী ব্যবহার করবেন না” - তা তিনি ইচ্ছাধীনভাবে করতেই পারেন।
আবার, ইচ্ছাধীন অভ্যাস (Voluntary habit) একটানা চলতে থাকলে সেটা অনৈচ্ছিক অভ্যাস (Involuntary habit) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে এবং সেটা একটানা অব্যহত থেকে অনৈচ্ছিক অভ্যাসের সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, ব্যাক্তি ইচ্ছাধীন কারনে মদ্যপান বা ধূমপান করলেন, তার কাছে তা ভালো লাগলো এবং পরবর্তী সময়ে তিনি অনিচ্ছাধীনভাবে মদ্যপান বা ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়লেন।
এখন, অভ্যাস বা Habit কে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি,
- ভালো অভ্যাস (Good habit): যা সামাজিক, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক ভাবে স্বীকৃত ও সম্মানযোগ্য, যা থেকে নিজের শারিরীক ও মানসিক উন্নয়ন হয়, যা থেকে পরিবার, সমাজ ও সংশ্লিষ্ট সকলের ভালো এবং শীক্ষনীয় হয়, তাই ভালো অভ্যাস। যেমন, দৈনিক প্রাতঃভ্রমন, নিয়মিত এবং নিদৃষ্ট সময়ে ধর্মীয়আচার পালন, সুস্থ ও সঠিক জ্ঞান আহরণ এবং তা সঠিকজনে বিতরণ, কম কথা বলা, একাগ্রচিত্তে এবং গভীর মনোযোগের সাথে কোন গঠনমূলক কাজ করা ইত্যাদি।
- বদঅভ্যাস (Bad habit): যা সামাজিক, পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক এবং অনেকসময় রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ও সম্মানযোগ্য নয়, যা থেকে নিজের শারিরীক ও মানসিক অধঃপতন হয়, যা থেকে পরিবার, সমাজ ও সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ভালো বা শীক্ষনীয় হয় না বরং ক্ষতি হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে তাই বদঅভ্যাস। যেমন, জুয়া খেলা, মদ্যপান, ধূমপান, অন্যকে অপমান অপদস্ত করা, উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা ইত্যাদি।
বদঅভ্যাস (Bad Habit)
“অভ্যাস”- এর মতো এতো বৃহৎ একটি বিষয়কে নিয়ে এত ছোট পরিসরে আলোচনা করা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব নয়। আমি সংক্ষেপে “বদঅভ্যাস (Bad habit) নিয়ে আলোচনা করছি।
ব্যক্তির ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছাকৃত আচরন এবং ক্রিয়াকলাপ যা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার এবং পরিবেশের জন্য শ্রুতি বা দৃষ্টিকটু, সামাজিকভাবে বেমানান এবং কখনো কখনো সামাজিক ও রাষ্ট্রবিরোধী তাই বদঅভ্যাস।
বদঅভ্যাস সাধারনত ব্যক্তির মুখভঙ্গি, দেহভঙ্গি, অভিব্যক্তি, শব্দ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং তার আশেপাশের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হয় না।
অনেকধরনের বদঅভ্যাসের মধ্যে সচরাচনদৃষ্ট বদঅভ্যাসগুলো হলো, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, আচমনে চুল ছেঁড়া (Hair pulling disorder), বারবার জিব দিয়ে ঠোঁট ভেজানো, নাকে হাত দেয়া, নাকে আঙ্গুল ঢোকানো, বারবার গলা পরিস্কার করা, অশালীন শব্দ উচ্চরন করা, হাতের আঙ্গুল ফোটানো, চেয়ারে পা তুলে বসা, পা নাচানো, দাঁত খোঁচানো, কলম চাবানো, কথায় কথায় অভিশাপ দেয়া অথবা প্রতিজ্ঞা করা ইত্যাদি। এছাড়াও মাদকাসক্তি ও মাদকাভ্যাসও অত্যন্ত নিম্নমানের বদঅভ্যাসের মধ্যেই পড়ে।
অনেকেই বক্তার প্রতি উত্তরে বারবার “জ্বী ?” অথবা “এ্যাঁ ?” অথবা “সরি ?” জাতিয় প্রশ্নবোধক শব্দ করেন, এটাও একধরনের বদঅভ্যাস এবং এটা যেমন শ্রুতিকট‚ তেমনি পরস্পরের কথপোকথনে তীব্র অসুবিধার সৃষ্টি করে, বক্তাকে একইকথা পুনরাবৃত্তি করতে হয়।
কারণ (Causation)
●. প্রকৃত কারণ অজানা।
●. নিজের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে না পারা।
●. সামাজিক ও পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব।
●. শৈশবের মারাত্মক দুঃখময় স্মৃতি।
কারা অধিক আক্রান্ত হন (More Prone To)
⮊. যে কেউ যে কোন বয়সে আক্রান্ত হতে পারেন, তবে সাধারণতঃ ৪ বছর বয়সের পূর্বে সূত্রপাত হয় না।
⮊. এটি অনেকসময় নির্ভর করে,
↳. আক্রান্ত ব্যক্তির বয়সের উপর।
↳.কি ধরণের বদঅভ্যাসে আক্রান্ত তার উপর।
↳.পারিপাশির্^ক অবস্থা, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটের উপর।
↳. বদঅভ্যাসের ধরণের উপর।
⮊. নারী অপেক্ষা পুরুষরা অধিক আক্রান্ত হন।
⮊. দরিদ্র শ্রেনীর ব্যক্তিরা অধিক আক্রান্ত হন।
⮊. যাঁরা নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ তাঁরা অধিক আক্রান্ত হন।
⮊. বদঅভ্যাসে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের সঙ্গে থাকা ব্যাক্তিদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
ক্লিনিক্যাল ফিচার’স (Clinical Features)
লক্ষন (Symptoms)
- একটি নিদৃষ্ট সময় অন্তর ঐচ্ছিক অথবা অনৈচ্ছিকভাবে অদ্ভুত, বিকৃত বা দৃষ্টিকটু আচরণ, শব্দ বা ক্রিয়াকলাপ করা।
- এইধরণের ক্রিয়াকলাপের জন্য অনুতাপ বা অনুশোচনা বা ভুল সংশোধনের চেষ্টা না করা।
- একই ক্রিয়াকলাপের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটানো।
চিন্থ (Signs)
চিন্থ নির্ভর করে, বদঅভ্যাসের ধরণের উপর।
ব্যবস্থাপনা (Management)
- রোগীকে মানসিকভাবে সহানুভ‚তি প্রদর্শন করতে হবে এবং তাঁর বদঅভ্যাসের কারণে তাঁকে লজ্জিত বা লাঞ্ছিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে, তার পরিবারের সকলকেও এ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিতে হবে।
- লক্ষনসাদৃশ্যে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করতে হবে।
- সর্বদা কথা কম বলার পরামর্শ দিতে হবে।
- কোন ভালো অভ্যাস (Good habit) গড়ে তোলার পরামর্শ দিতে হবে।
শেষকথা
বদঅভ্যাস দূর করার জন্য কেবল চিকিৎসাই যথেষ্ট নয়, কারণ বদঅভ্যাস দূর করার জন্য আক্রান্ত ব্যাক্তির দুইটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণ থাকতে হবে যে, “এটি তার একটি বদঅভ্যাস” এবং “এটি থেকে তার বেরিয়ে আসা জরুরী।” আক্রান্ত ব্যাক্তি যদি তাঁর বদঅভ্যাস থেকে মুক্ত হতে না চান, তবে কোন চিকিৎসা পদ্ধতিই তাঁর কোন সাহায্য করতে পারবে না। বদঅভ্যাস থেকে মুক্ত হতে চাইলে বদঅভ্যাসগ্রস্থ ব্যক্তিকে সচেতনতামূলক আচরন করতে হবে এবং তার আচরন এবং অভ্যাসের উপর নিয়ন্ত্রন রাখা শিখতে হবে।
আশার কথা,
হোমিওপ্যাথিতে এই সকল “বদঅভ্যাস সমৃদ্ধ অনেক লক্ষন” আছে, যা বিশেষ কিছু ঔষধের প্রতি ঈঙ্গিত প্রদশ্রন করে, সুতরাং ঈঙ্গিতগলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে যত্ন সহকারে ঔষধ নির্বাচন করলে এবং ঔষধের অপব্যবহার না করলে রোগী অবশ্যই বদঅভ্যাসমুক্ত হবেন।
যে কোন সমস্যায় আপনার নিকটস্থ দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।
আপনার সুস্বাস্থ্য ও সার্বিক মঙ্গল কামনায়,
বি.এইচ.এম.এস.
নওয়াব আলী হোমিও চিকিৎসালয়, বালুবাগান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
প্রাক্তন প্রভাষক, রহনপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।