নওয়াব আলী হোমিও চিকিৎসালয় (ডাঃ নওয়াব আলী প্রফেসরের বাসা), ৩৬৬, বালুবাগান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
+৮৮০-১৭২০-৬৬৭১১৭
মেগালোব্লাষ্টিক এনিমিয়া (Megaloblastic Anemia)

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Megalo শব্দের অর্থ “বড়” বা “বৃহদাকৃতির” এবং Blast অর্থ “রক্তের অপরিনত কোষ (Immature blood cell)।” আমরা জানি, রক্তে তিনধরনের কনিকা বা কোষ বিদ্যমান, যাদের লোহিত রক্তকনিকা বা Red blood cell (R.B.C) বা Erythrocyte, স্বেত রক্তকনিকা বা White blood cell (W.B.C) বা Leucocyte এবং অনুশ্চক্রিকা বা Platelet বা Thrombocyte বলে। রক্তের Red blood cell যখন আমাদের অস্থিমজ্জাতে (Bone marrow) উৎপাদিত হয় তখন তারা অপরিনত থাকে এবং তাদের মধ্যে নিউক্লিয়াসও থাকে। কিন্তু কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে যখন তারা কার্যোপযোগী R.B.C তে রুপান্তরিত হয়, তখন ক্রমান্বয়ে তারা ছোট আকৃতির হতে থাকে এবং তাদের নিউক্লিয়াসও ছোট হতে হতে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ, পরিণত (Mature) এবং কার্যোপযোগী Red blood cell  এবং Platelet এ কোন নিউক্লিয়াস (Nucleus) থাকে না। কিন্তু শরীরে ভিটামিন B12 এবং ফলিক এসিডের ঘাটতি হলে অস্থিমজ্জা বা Bone marrow তে সঠিকভাবে DNA Synthesis হয় না, ফলে R.B.C এবং তার মধ্যস্থ নিউক্লিয়াস ছোট না হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং এরা একসময় অস্থিমজ্জা থেকে রক্তনালীর মাধ্যমে রক্তস্রোতে প্রবেশ করে। যেহেতু, কার্যত এরা বিকৃতধরনের Red blood cell, সেহেতু এরা যথাযথভাবে অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে না, এদের আয়ুস্কালও অনেক কম হয়, দ্রুত নষ্ট হতে থাকে, এনিমিয়াসহ আনুষাঙ্গিক আস্বাভাবিক লক্ষনের সৃষ্টি হয়, যেটাকে আমরা মেগালোব্লাষ্টিক এ্যানিমিয়া (Megaloblastic anemia) বলে থাকি। এটিকে ম্যাক্রোসাইটিক (Macrocytic) এনিমিয়ার মধ্যে গন্য করা হয়।

কারন (Causation)

①. ভিটামিন B12 এর অভাবজনিত কারন, যেমন

     Ⅰ . পর্যাপ্ত পরিমানে গ্রহন না করা, যথা

               ➥. কঠোরভাবে নিরামিশভোজী।

               ➥. পর্যাপ্ত পরিমানে পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহন না করা।

               ➥. বার্ধক্য।

     Ⅱ . শোষন ক্রিয়ার ঘাটতি,

          ●. পাকস্থলী সংক্রান্ত, যেমন

               ➥. পাকস্থলীর আংশিক অপসারন বা Partial gastrectomy

               ➥. জন্মগতভাবে পাকস্থলীতে গ্লাইকোপ্রোটিন (Glycoprotein) নামক Intrinsic factor এর অভাব।

               ➥. পার্নিসাস এ্যানিমিয়া।

          ●. ক্ষুদ্রান্ত্রের রোগ সংক্রান্ত, যেমন

               ➥. ব্যাক্টেরিয়ার অতিবৃদ্ধি।

               ➥. ক্রন’স ডিজিজ (Crohn's disease)।

               ➥. ট্রপিক্যাল স্পূর।

               ➥. সিলিয়াক ডিজিজ।

               ➥. ফিতা ক্রিমির সংক্রামন (Tapeworm infection)।

     Ⅲ. চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, যেমন

               ➥. গর্ভাবস্থায়।

               ➥. ক্যান্সারের বিস্তারশীল অবস্থায়।

     Ⅳ. অন্যান্য কারন, যেমন

               ➥. HIV সংক্রামন।

               ➥. মারাত্মক অগ্ন্যাশয়ের রোগ (Severe pancreatic disease।

               ➥. বিশেষ কিছু ঔষধ, যেমন কলচিসিন (Colchicine), নিওমাইসিন (Neomycin), মেটফর্মিন (Metformin)।

②. ফলিক এসিড (B9) এর অভাবজনিত কারন, যথা

     Ⅰ. পর্যাপ্ত পরিমানে গ্রহন না করা, যথা

               ➥. অপুষ্টি।

               ➥. বার্ধক্য।

               ➥. দারিদ্রতা।

               ➥. অধিক পরিমানে ছাগলের দুগ্ধপান।

               ➥. মদ্যপান।

               ➥. কশিওকর (Kwashiorkor)।

     Ⅱ . শোষন ক্রিয়ার ঘাটতি,

               ➥. সিলিয়াক ডিজিজ।

               ➥. ডার্মাটাইটিস হার্পিটিফর্মিস (Dermatitis herpetiformis)।

               ➥. ট্রুপিক্যাল স্পূর।

               ➥. জন্মগত ফলেট এর সংশ্লেষনের ঘাটতি।

               ➥. মুখে সেব্য জন্মবিরতিকরণ বড়ি সেবন।

     Ⅲ. চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, যেমন

               ➥. শৈশব অবস্থায়।

               ➥. গর্ভাবস্থায়।

               ➥. হেমোলাইটিক এ্যানিমিয়ায়।

     Ⅳ. বিশেষ কিছু ঔষধ, যেমন

               ➥. মেথোট্র্যাক্সিট (Methotrexate)।

               ➥. পাইরিমেথামাইন (Pyrimethamine)।

               ➥. ট্রাইমেথোপ্রিম (Trimethoprime)।

               ➥. খিঁচুনীরোধী ঔষধ সেবন।

     Ⅴ. শরীর থেকে অতিরিক্ত বেরিয়ে যাওয়া (ফলিক এসিড এবং ভিটামিন B12 উভয়ই),

               ➥. ট্রপিক্যাল স্পূর।

               ➥. নন্-ট্রপিক্যাল স্পূর।

               ➥. হেমোডায়ালাইসি।

কারা অধিক আক্রান্ত হন (More prone to)

যাঁদের বংশে মেগালোব্লাষ্টিক এনিমিয়া আছে তাঁদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে।

যাঁরা অপুষ্টিতে ভোগেন এবং পুষ্টিকর খাদ্য খান না অথবা যাঁরা খাদ্যের গুনগতমান সম্পর্কে সচেতন নন তাঁরা অধিক আক্রান্ত হন।

নিরামিষভোজীরা অধিক আক্রান্ত হন।

মদ্যপায়ীরা অধিক আক্রান্ত হন।

আইবিএস আক্রান্ত রোগীদের হবার সম্ভাবনা অধিক থাকে।

হাইপারথাইরয়েডিজম আক্রান্ত রোগীদের মেগালোব্লাষ্টিক এনিমিয়া হবার সম্ভাবনা অধিক থাকে।

ক্লিনিক্যাল ফিচারস্ (Clinical features)

লক্ষন (Symptoms)

⮊. রক্তাল্পতার দরুন লক্ষনসমূহ, যেমন

     ⮲. রোগী অল্পেই ক্লান্তবোধ করবে।

     ⮲. সামান্যতে হাঁপিয়ে যাবে।

     ⮲. শ্বাসকষ্ট হবে।

     ⮲. পুরাতন ক্ষেত্রে বুকব্যথা এবং হৃদরোগ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে।

⮊. পরিপাকতন্ত্র সংক্রান্ত লক্ষনসমূহ, যেমন

     ⮲. বারবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হবে।

     ⮲. ক্ষুধা কমে যাবে।

     ⮲. জিহ্বার প্রদাহ (Glossitis) এবং ঠোঁটের কোনে ক্ষত (Angular stomatitis) হবে।

     ⮲. মৃদ্যু থেকে মাঝারীধরনের জন্ডিস দেখা দেবে।

     ⮲. প্রস্রাব কমলাবর্নের হবে।

⮊. স্নায়ুতন্ত্র সংক্রান্ত লক্ষনসমূহ, যেমন

     ⮲. মানসিক গোলযোগ দেখা দেবে, যেমন

            ↳. শিশুসূলভ আচরণ করবে।

            ↳. অল্পেই উত্তেজিত হয়ে যাবে।

            ↳. সামান্যতেই অতি আবেগপ্রবন হয়ে যাবে এবং নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারবে না।

     ⮲. পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি দেখা দেবে, বিশেষতঃ দুই হাতে,

            ↳. ব্যথা ও কনকন করা অনুভ‚তি হবে।

            ↳. অকারনে ভীষন জ্বালাবোধ হবে।

            ↳. প্রায় ঝি-ঝি ধরবে।

            ↳. প্রায় অবশবোধ হবে।

            ↳. একটানা কোন কিছু ধরে রাখতে বা কাজ করতে অসুবিধা হবে।

            ↳. অনুভ‚তিগুলো স্থান পরিবর্তনশীল প্রকৃতির হবে।

⮊. হৃৎপিন্ড সংক্রান্ত লক্ষনসমূহ, যেমন

     ⮲. শীরায় রক্তাবদ্ধতা (Venous thrombosis)।

     ⮲. ধমনীর আবদ্ধতা (Arterial obstruction)।

⮊. সার্বদৈহিক লক্ষনসমূহ, যেমন

     ⮲. ওজন কমে যাওয়া।

     ⮲. শরীরে শোথ দেখা দেয়া।

     ⮲. বিবর্ন ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।

     ⮲. দৃষ্টিশক্তির গোলযোগ, যেমন ঝাপসা দেখা, ইত্যাদি লক্ষন দেখা দেবে।

চিন্থ (Signs)

●. রোগী রক্তশূন্য (Anaemic) ও ফ্যাকাশে।

●. ত্বক বিবর্ন ও ফ্যাকাশে এবং উজ্জ্বলতাহীন।

●. খিটখিটে মেজাজ।

●. অত্যাধিক দূর্বলতা ও অবসন্নতা।

●. হাঁটতে অসুবিধা হওয়া।

●. নকোল পিগমেন্টেশান (Knuckle pigmentation) পাওয়া যাবে।

“জেনে রাখা ভালো”

প্রাকৃতি থেকে প্রাপ্ত B9 এর উপাদানগুলো 15 মিনিটের অধিক সময়কাল সেদ্ধ করলে তার গুনাগুন কমে যায়, অপরদিকে B12 এর দৈনিক প্রয়োজন 2.4 micrograms (mcg), যা দীর্ঘক্ষন সেদ্ধ করলেও গুনাগুন ততটা কমে না। এইকারণে, শরীরে ভিটামিন B9 এর ঘাটতি যত দ্রত এবং যতটা পরিমানে দেখা যায়, B12 এর ঘাটতি সুস্থ স্বাভাবিক শরীরে চট করে ততটা কমে না।

জটিলতা (Complications)

মানসিক গোলযোগ এবং স্নায়ুসংক্রান্ত জটিলতা।

স্মৃতিশক্তির দূর্বলতা।

হাত-পায়ের দূর্বলতা, অবশতা, ঝিঁ-ঝিঁ ধরা।

বন্ধ্যাত্ব (তবে পর্যাপ্ত পরিমানে ফলিক এসিড (B9) এবং ভিটামিন B12 প্রয়োগে এধরণের বন্ধ্যাত্ব আরোগ্যযোগ্য)।

   ⮲. গর্ভিনীর ক্ষেত্রে,

        ►. গর্ভপাত।

   ⮲. প্রসব পরবর্তী শিশুর ক্ষেত্রে,

        ►. স্পাইনা বিফিডা (Spina bifida)।

ব্যাবস্থাপনা (Management)

রোগীকে আশ্বস্ত করতে হবে।

লক্ষন সাদৃশ্যে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে ফলিক এসিড (B9) এবং ভিটামিন B12 সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। প্রয়োজনে বাজারে যে সকল ফলিক এসিড (B9) এবং ভিটামিন B12 আছে সেগুলো দিতে হবে।

ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবারভিটামিন B12 সমৃদ্ধ খাবার
সবুজ শাক-সব্জি।মাছ, সামদ্রিক মাছ, শুটকী।
সীম এবং সীমের বিজ।গরুর মাংস।
আখরোট, বাদাম, কাঠবাদাম।খাসির মাংস।
ব্রæকলি।মুরগীর মাংস।
কমলালেবুর জুস।গরু, খাসি, মুরগীর যকৃত, বৃক্ক।
যকৃত, বৃক্ক, সামদ্রিক মাছ, শুটকী।দুধ, ডিম।
বার্লি।চিংড়ী, লবষ্টার।
লেটুস পাতা, লেবু ইত্যাদি।মিষ্টি কুমড়ো, গাজর, পেঁপে ইত্যাদি।

রোগী গর্ভবতী হলে ফলিক এসিড (B9) এবং ভিটামিন B12 এর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে।

প্যাথলজীক্যাল ইনভেষ্টিগেশান (Pathological investigations)

  • Vitamin B12. (প্রাপ্তবয়স্ক একজন সুস্থ মানুষের শরীরে কোবালামিন (Cobalamin) বা ভিটামিন B12 এর স্বাভাবিক পরিমাপ 160 pg/ml থেকে 950 pg/ml)।
  • Folate. (প্রাপ্তবয়স্ক একজন সুস্থ মানুষের শরীরে ফলিক এসিডের (B9) এর স্বাভাবিক পরিমাপ 2.7ng/ml থেকে17ng/ml )।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে (5ng/ml থেকে 21ng/ml)।
  • নবজাতকের ক্ষেত্রে (14ng/ml থেকে 51ng/ml)।
  • CBC (Complete blood count),
  • MCV↑, MCH↑, MCHC↓ অথবা স্বাভাবিক পাওয়া যাবে।
  • Peripheral blood film.
  • Reticulocyte count.

যে কোন সমস্যায় আপনার নিকটস্থ দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।

আরও জানতে ক্লিক করুনঃ এনিমিয়া (Anaemia) বা রক্তাপ্লতা, এ্যপ্লাস্টিক এনিমিয়া (Aplastic Anemia), আয়রণ ডিফিসিয়েন্সী এনিমিয়া (Iron Deficiency Anaemia)

আপনার সুস্বাস্থ্য ও সার্বিক মঙ্গল কামনায়

ডা. রাতুল মাহমুদ সজল

বি.এইচ.এম.এস.

নওয়াব আলী হোমিও চিকিৎসালয়, বালুবাগান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

প্রাক্তন প্রভাষক, রহনপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

About Author

One thought on “মেগালোব্লাষ্টিক এনিমিয়া (Megaloblastic Anemia)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *